Wednesday, May 1, 2024
HomeAgriculturalবোরো ধান এর আধুনিক চাষ পদ্ধতি

বোরো ধান এর আধুনিক চাষ পদ্ধতি

আশা করি সবাই ভাল আছেন। আজকে আমরা আলোচনা করবো বোরো ধানের আধুনিক চাষ পদ্ধতি নিয়ে।

আপনারা জানেন সারা দেশে এখন বোরো ধানের চারা রোপণ চলছে। কেউ কেউ নিচু জমিতে জমে থাকা প্রাকৃতিক পানির সদ্ব্যবহার করতে একটু আগেই চারা রোপণের কাজ শুরু করেছেন। আবার দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চেয়ে উত্তরাঞ্চলে চারা রোপণ হবে একটু পরে।

তবে অনেক সময়ই চারা রোপণের পর বোরোচাষিরা গাছ আশানুরূপভাবে বেড়ে না ওঠার সমস্যার কথা বলেন। কেউ কেউ বোরো ধানের ক্ষেতে বেশি রোগ ও পোকা আক্রমণের সমস্যায় ভোগেন। বোরো ধানে কীটনাশক কি দিতে হবে বোরো ধানের সার ব্যবস্থাপনা কি রকম হবে তা অনেকে জানেন না।

আসলে সঠিকভাবে বোরো ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি বা পাতাখোলা থেকে বোরো ধানের চারা না তুলতে পারলে এবং সঠিক পদ্ধতিতে তা রোপণ করতে না পারলে এসব সমস্যা দেখা দেয়।

বোরো ধানে সার দিয়েও জমির গাছ বড় করে তোলা যায় না এবং বিভিন্ন বালাইয়ের আক্রমণে ফলন অনেক কমে যায়।

তাই গোড়ায় গলদ না রেখে চারা রোপণের সময়ই বোরোচাষিরা একটু সতর্ক হয়ে সঠিক পদ্ধতিতে চারা তুললে ও রোপণ করলে ভালো ফসল পেতে পারেন।

আসুন, বোরো ধান চাষ পদ্ধতি, বোরো ধান কখন চাষ হয়, বোরো ধানের দাম ২০২১, বোরো ধানের জাত বা বোরো ধানের আধুনিক জাত, বোরো ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি, বোরো ধানের সার ব্যবস্থাপনা,বোরো ধানে কীটনাশক কি দিতে হবে, বোরো ধানের ফলন বৃদ্ধির উপায়, বোরো ধান কাটার সময় ইত্যাদি সঠিক পদ্ধতিগুলো জেনে নেয়া যাক।

বোরো ধান কখন চাষ হয় এবং বোরো ধানের দাম ২০২১ এ কত?

ধান রোপণ শুরু হয় বাংলা কার্তিক (অক্টোবর-নভেম্বর) মাস থেকে এবং এই ধান কাটা চলে বাংলা বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-জুন) মাস পর্যন্ত। বছরের হেমন্ত কালের শুরু থেকে গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই ধানের সময় চলে এবং এই ধানের মূল ফলন বসন্তকালে হয় বলে একে বাসন্তিক ধান বলেও ডাকা হয়। ভারতে বোরো ধানকে বৈশাখী ধান নামেও ডাকা হয়

বর্তমানে বোরো ধানের দাম মণপ্রতি ১৫০০ টাকা।

বোরো ধানের জাত বা বোরো ধানের আধুনিক জাত গুলো কি?

বর্তমানে বাজারে বোরো ধানের অনেক প্রকারের জাত রয়েছে। এরকম খুব পপুলার কয়েকটি জাত এর তালিকা নিচে দেওয়া হলঃ

  • বিআর১ , বিআর২, বিআর৩, বিআর৬, বিআর৭, বিআর৮, বিআর৯
  • বিআর১২, বিআর১৪, বিআর১৫, বিআর১৬, বিআর১৭, বিআর১৮, বিআর১৯
  • ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৩৫, ব্রি ধান৩৬, ব্রি ধান৪৫, ব্রি ধান৪৭
  • ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৫৮, ব্রি ধান৫৯, ব্রিধান৬০ ইত্যাদি।

এছাড়া আরও রয়েছে-

  • ব্রি ধান৬১, ব্রি ধান৬৩, ব্রি ধান৬৪, ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৬৮, ব্রি ধান৬৯, ব্রি ধান৭৪
  • ব্রি ধান৮১, ব্রি ধান৮৪,ব্রি ধান৮৬, ব্রি ধান৮৮, ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২
  • ব্রি হাইব্রিড ধান১, ব্রি হাইব্রিড ধান২, ব্রি হাইব্রিড ধান৩
  • ব্রি হাইব্রিড ধান৫, ব্রি ধান৯৬, ব্রি ধান৯৭, ব্রি ধান৯৯, ব্রি ধান১০০ ইত্যাদি।

 

বোরো ধানের সার ব্যবস্থাপনা এবং বোরো ধানে কি ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে?

সাধারণভাবে ১৫০ দিনের নিচে স্বল্প মেয়াদি জাত যেমন- ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৫, ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮১, ব্রি ধান ৮৪, ব্রি ধান৮৬, ব্রি ধান৮৮ ব্রি হাইব্রিড ধান৩, ব্রি হাইব্রিড ধান৫ বা বিনা ধান-১০ এবং বিনা ধান-১৮ এর ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি অর্থাৎ প্রতি ৩৩ শতকে সারের মাত্রা ইউরিয়া ৩৫ কেজি, টিএসপি বা ডিএপি ১২ কেজি, এমওপি ২০ কেজি, জিপসাম বা গন্ধক ১৫ কেজি, দস্তা (মনোহাইড্রেট) ১.৫ কেজি।

১৫০ দিনের বেশি দীর্ঘমেয়াদি জাত যেমন- ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৫৮ বা ব্রি ধান৬৯, ব্রি ধান৮৯ এর ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি অর্থাৎ প্রতি ৩৩ শতকে সারের মাত্রা ইউরিয়া ৪০ কেজি, টিএসপি বা ডিএপি ১৩ কেজি, এমওপি ২২ কেজি, জিপসাম ১৫ কেজি, দস্তা ১.৫ কেজি। হাওর অঞ্চলের জাতের ক্ষেত্রে প্রতি ৩৩ শতকে সারের মাত্রা ইউরিয়া ২৭ কেজি, টিএসপি বা ডিএপি ১২ কেজি, এমওপি ২২ কেজি, জিপসাম ৮ কেজি, দস্তা ১.৫ কেজি। তবে টিএসপির বদলে ডিএপি সার ব্যবহার করলে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি ইউরিয়া সার কম প্রয়োগ করতে হবে।

টিএসপি বা ডিএপি, এমওপি, জিপসাম ও দস্তা সারের পুরোটাই শেষ চাষের সময় মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে দস্তা ও টিএসপি একসাথে না মিশিয়ে পৃথকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সারকে সমান তিন ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে

স্বল্পমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে ১ম কিস্তি চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর, ২য় কিস্তি চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর এবং শেষ কিস্তি কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে। দীর্ঘমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে ১ম কিস্তি শেষ চাষের সময়, ২য় কিস্তি চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর অর্থাৎ গোছায় কুশি দেখা দিলে এবং শেষ কিস্তি কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে।

সার প্রয়োগ ও পদ্ধতি নিয়ে আরও কিছু পরামর্শ মেনে চলতে হবে। জমিতে পর্যাপ্ত জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। জৈব সারের সাথে রাসায়নিক সার সমন্বয় করে ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় ও ভালো ফলন হয়। জমিতে বছরে একবার হলেও বিঘাপ্রতি ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে

বোরো ধান এর আধুনিক চাষ পদ্ধতি
বোরো ধান পরিদর্শনে হাটাহাজারী কৃষি ইনষ্টিটিউটের এক দল শিক্ষার্থী

আমন মৌসুমে যে জমিতে জৈব সার ব্যবহার করা হবে সে জমিতে বোরো মৌসুমে ইউরিয়া সার নির্ধারিত মাত্রার তিন ভাগের এক ভাগ কম ব্যবহার করতে হবে। টিএসটি ও এমওপি সার অর্ধেক মাত্রায় ব্যবহার করলেও আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাবে।

এছাড়া ধান কাটার সময় গাছের গোড়া থেকে ১০-১২ ইঞ্চি ওপরে কেটে নাড়া মাটিতে মিশিয়ে দিলে পটাশ সারের পরিমাণ তিন ভাগের এক ভাগ কম লাগে।

দস্তা বা জিঙ্ক সালফেট সার ফসলচক্রের কোন একটিতে ব্যবহার করলে তা পরবর্তী দুই ফসলের জন্য ব্যবহার না করলেও চলবে।

বেলে মাটিতে চার কিস্তিতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করাই ভালো

জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা অবস্থায় ইউরিয়া সার সমভাবে ছিটানোর পর হাতড়িয়ে বা নিড়ানি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারলে ভালো ফলন আশা করা যায়। তীব্র শীতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করা যাবে না

ইউরিয়া সারের অপচয়রোধে এবং ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা বাড়াতে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে। এজন্য এক মৌসুমে প্রতি চারটি গোছার জন্য ২.৭ গ্রাম ওজনের একটি মেগাগুটি প্রয়োগ করলেই যথেষ্ঠ।

যদি কোনো কারণে গন্ধক বা দস্তা ব্যবহার করা না হয় তাহলে গাছের গন্ধক বা দস্তার অভাবজনিত লক্ষণ বুঝে সার দিতে হবে।

বোরো ধান চাষ পদ্ধতি ও চারা তোলাঃ

বীজতলা থেকে চারা তোলার আগে বীজতলা শুকনো থাকলে তা পানি দিয়ে একরাত ভিজিয়ে রাখতে হবে।বীজতলা থেকে চারা সাবধানে তুলতে হবে। তোলার সময় লক্ষ রাখতে হবে যাতে চারার গোড়া ছিঁড়ে না যায় বা শিকড় কম ছেঁড়ে।

এসব ক্ষতের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া জীবাণু জমিতে থাকলে সুস্খ চারায় তার অনুপ্রবেশ ঘটে এবং পরে তা ক্ষেতের গাছে পাতাপোড়া রোগ সৃষ্টি করে।

চারা তোলার পর পায়ের গোড়ালিতে আঘাত করে গোড়ার মাটি ছাড়ানো ঠিক নয়, এতে চারার ঘাড় ভেঙে যেতে পারে। পরে এসব চারা জমিতে রোপণ করলে মরে যেতে পারে বা আঘাত সেরে উঠে জমিতে রোপণ করতে বেশি দিন লাগতে পারে।

বোরো ধান এর আধুনিক চাষ পদ্ধতি
বোরো ধান চাষ করছে হাটহাজারী কৃষি ইনষ্টিটিউটের কিছু শিক্ষার্থী

বোরো ধানের চারা মজুদ ও স্থানান্তরঃ

চারা বীজতলা থেকে তোলার পর দুই দিনের মধ্যেই রোপণ করতে হবে। কোনো কারণে চারা রেখে দিতে হলে চারার গোড়া পানির মধ্যে চুবিয়ে রেখে দিতে হবে। চারা কখনো বস্তায় ভরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেয়া ও রাখা উচিত নয়। ঝুড়িতে নিতে হবে ও খোলা জায়গায় ছায়ায় রাখতে হবে।

বোরো ধানের চারা বাছাই ও শোধনঃ

চারা তোলার পর রোপণের আগে তা থেকে রোগগ্রস্ত ও পোকায় আক্রান্ত চারা বেছে বাদ দিতে হবে। সম্ভব হলে চারা রোপণের আগে প্রতি লিটার পানিতে এক গ্রাম ব্যাভিস্টিন ছত্রাকনাশক গুলে সেই পানিতে ১০ মিনিট চারার গোড়া বা শিকড় ভিজিয়ে রেখে জমিতে রোপণ করতে হবে। এতে চারা তোলার সময় যদি তাতে কোনো জীবাণুর সংক্রমণ ঘটে তবে সেগুলো নষ্ট হবে।

বোরো ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি করবেন কিভাবে?

চারা রোপণের আগে অবশ্যই জমি ভালো করে চাষ দিয়ে কাদা করতে হবে ও আইল বাঁধতে হবে। চাষের সময় অনুমোদিত মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার (ইউরিয়া বাদে অন্যান্য সার) শেষ চাষের সময় মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।

 জমি চাষের পর তা সমতল করে অল্প পানি (২-৩ ইঞ্চি) আটকে রাখতে হবে।

যে দিন চারা রোপণ করা হবে ঠিক তার আগের দিন জমি চাষ দিয়ে সমতল করা ভালো। এতে নরম হয়ে যাওয়া মাটি একটু থিতিয়ে যায়। ফলে রোপণ করা চারা সহজে হেলে পড়ে না বা রোপণের পর উঠে আসে না।

তবে বেলে মাটিতে দিনে দিনেই চাষ দিয়ে চারা রোপণ করতে হবে, না হলে মাটি শক্ত হয়ে যাবে এবং সে জমিতে চারা রোপণ করতে অসুবিধা হবে।

বোরো ধানের রোপণ উপযোগী চারার বৈশিষ্ট্যঃ

রোপণের জন্য চার-পাঁচটি পাতাযুক্ত চারা নির্বাচন করতে হবে। সঠিক বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। চারার বয়স হবে হাইব্রিড জাতের বেলায় ২০-২২ দিন, মাঝারি জীবনকালের জাতের বেলায় ২৫-৩০ দিন এবং দীর্ঘ জীবনকালের বা নাবি জাতের চারার বেলায় ৩৫-৪০ দিন।

কোনো কারণে চারার বয়স বেশি হলে আঁটি ধরে চারার মাথা বা আগা থেকে কিছুটা পাতা ছিঁড়ে ফেলে রোপণ করতে হবে।

বোরো ধানের চারা রোপণ পদ্ধতিঃ

প্রতি গুছিতে দুই থেকে তিনটি চারা রোপণ করা উচিত। এতে এক দিকে বীজের যেমন সাশ্রয় হয় তেমনি গাছে কুশিও ভালো গজায়। মাটির ২ থেকে ২.৫ সেন্টিমিটার (১-১.৫ ইঞ্চি) গভীরে চারা রোপণ করা উচিত। বেশি গভীরে চারা পুঁতলে মাটিতে লাগতে ও কুশি ছাড়তে দেরি হয় এবং বাড়তি কমে যায়।

বোরো ধানের চারা রোপণ পদ্ধতিঃ

দূরত্ব হাইব্রিড জাতের ক্ষেত্রে চারা থেকে চারার দূরত্ব ২০ সেন্টিমিটার ও সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ সেন্টিমিটার দিতে হবে। অন্যান্য আধুনিক জাতের ক্ষেত্রে সব দিকে ২০ সেন্টিমিটার দূরত্ব দিলেই চলে।

স্বল্প জীবনকালের জাতের ক্ষেত্রে এই দূরত্ব ১৫ সেন্টিমিটার থেকে ২০ সেন্টিমিটার দেয়া যেতে পারে। চারা রোপণের পর জমিতে অবশ্যই ছিপছিপে পানি রাখতে হবে।

বোরো ধান চাষে ফাঁকা জায়গা পূরণ করবেন কিভাবে?

রোপণের পর কিছু চারা মরে যেতে পারে। সে জন্য রোপণের সময় জমির এক কোণে কয়েক গুছি চারা পুঁতে রাখতে হবে, যাতে পরে সেসব চারা থেকে ফাঁকা জায়গায় আবার চারা লাগানো যায়। এতে চারার বয়স ঠিক থাকে। ফলে গাছের বাড়তি ও ফলন হয় প্রায় একই রকম।

অনেক ধন্যবাদ ধৈর্য্য ধরে বোরো ধানের আধুনিক চাষ পদ্ধতি নিয়ে আমাদের আজকের পর্বটি ভালভাবে পড়ার জন্য। আশা করি আপনারা আপনাদের প্রশ্নগুলো করে আমাদের সামনে আরও পর্ব নিয়ে আসার জন্য উৎসাহী করবেন।

Related News
- Advertisment -

Popular News

error: Content is protected !!