Home Education শিবখালী – একটি ধর্মীয় সম্প্রীতির গল্প

শিবখালী – একটি ধর্মীয় সম্প্রীতির গল্প

3
শিবখালী- একটি ধর্মীয় সম্প্রীতির গল্প।

মানুষ বড়ই অদ্ভুত। বিশ্বাসকে অবিশ্বাস আর অবিশ্বাসকে বিশ্বাস করা মানুষের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। তারপরও বিবেক বলে একটা শব্দ থেকে যায়,যেটি ভালোবাসার হাত দিয়ে সম্প্রতি শেখায়।

২০১৯, শিবখালী দ্বীপ।

তখন আষাঢ় মাস,জোরে বাতাস বইছে আর মাঠে বাঁধা গরু গুলো হাম্বা হাম্বা করে ডাকছে। আকাশে বিজলী,সৃষ্টিকর্তা শক্তি প্রদর্শনে ব্যস্ত। হঠাৎ,গরু গুলো নিয়ে গোয়ালঘরে ঢুকেছে বিশ্বনাথ। পথে বিশ্বানাথের সাথে হোসেন মিয়ার দেখা এবং হোসেন মিয়ার মুখে শোকরিয়া।

তারপর দিন…

শুক্রবার,ঈমাম সাহেব আজ বেশ গরম। খুতবা দেওয়ার আগে মসজিদে জোরে জোরে বয়ান দিচ্ছে, একটু পর পর “ঠিক কিনা”।বারান্দা থেকে মানুষের ভীড় থেকে হোসেন মিয়ার ঈমাম সাহেবের দিকে দৃষ্টি। সাথে সাথে ঈমাম সাহেব বলে ওঠলো,”এই হোসেন মিয়া হিন্দুদের সাথে চললে মসজিদে আসবি না,কারন পোঁড়া মানুষের গন্ধ লাগে”।

বিকাল বেলা,

বাজারের সব মানুষ আতঙ্ক,সবার মুখে একটাই কথা, “আলী আকবর মুন্সী ” যে স্বপ্ন দেখেছে তা শয়তানি ষড়যন্ত্র ।কৃষক,মাঝি,মোল্লা থেকে শুরু করে সবাই আলী আকবর মুন্সীর স্বপ্ন নিয়ে ক্ষুব্ধ। স্বপ্নটা ছিলো হিন্দুদের শিব মন্দিরে শিবের পূজা করতে না দিলে শিব দেবতা শিবখালীকে সাগরে বিলীন করে দিবে।মুসলিমদের মনে একটাই দুঃখ,একজন মুসলমান কি করে আজগবি শয়তানি স্বপ্ন দেখে।স্বপ্নের বর্ণনাতে মুসলিমরা আরও ক্ষিপ্ত। তারা শিব দেবতার মন্দির ভেঙ্গে দিবে।শয়তানি স্বপ্ন দেখার কারনে আকবর মুন্সী পাহাড়ে গা ঢাকা দিয়েছে।আকবর মুন্সীর কয়েকদিন ধরে পাহাড়েই তার বসবাস শুরু করেছে।

তারপর দিন…

বিলাত থেকে একদল গবেষক এসেছে,গবেষণার বিষয় “সমাজ ও সংস্কৃতির বিবর্তন“। তাদের গবেষণা মতে “শিব” দেবতার নাম থেকে দ্বীপের নাম “শিবখালী” নামকরন।উপজেলা সেমিনারে গবেষকদের এমন বক্তব্যে চিন্তিত উপজেলা চেয়ারম্যান। পাশাপাশি মোল্লাদেরও চোখে ঘুম নাই,সবাই দেবতার নামে দ্বীপে নিজের জন্ম নেওয়াকে ভীষণ পাপ মনে করতে শুরু করছে। তাই তারা পুরো উপজেলা ব্যাপী এক ওয়াজ মাহফিলের আয়োজনের ব্যবস্হা নিয়েছে। যেখানে দেশ সেরা মৌলভীরা ওয়াজ করবে। উদ্দেশ্য চেয়ারম্যানের একটাই, দেবতার নাম মুছে থাকে বেহেশতে যেতে হবে। দিন তারিখ ঠিক করা হলো। যথারীতি মৌলভীরা “শিবখালী” নামটা কে শিরকের শামিল বলে ঘোষনা করলেন। তাই যার কারনে দ্বীপের মানুষ, দ্বীপের নতুন নাম দিয়ে কবরের আযাব থেকে বাঁচতে চায়।

তারপর দিন..

স্কুল ভিটায় এদিক ওদিক হাঁটছে জহির মাস্টার।মনে একটা দুঃখ এতোদিনের দ্বীপের ঐতিহ্য কিভাবে বাঁচানো যায়। মাস্টারের মনে মনে, “এই মাটি আমার মা,এই মাটি মায়ের মা”।মাস্টার দৌড়ে সাইকেল চড়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটাছুটি শুরু করেছে। সবাইকে বুঝাতে শুরু করেছে “শিবখালী আমাদের মা। মায়ের কোলে আমরা বড় হয়েছি,আমাদের মা হিন্দু হলে তাহলে কি আমরা মা ডাকতাম না “।

মানুষ গুলো খুবই অসহায়,যার কথা শুনে তার কথায় বিশ্বাস করা শুরু করে দেয়। তবে এ কতক্ষণ, যা গ্রীষ্মের বর্ষার মতো, পানি দ্রুত শুকিয়ে যায়।

৭জুন,২০১৯।

উপকূলীয় অঞ্চল সমূহকে ৯ নম্বার বিপদ সংকেত দেখিয়ে দিতে বলা হয়েছে।শিবখালীর মানুষ গুলো মৃত্যুর সাথে কঠিন পাঞ্জা লড়ছে,কেননা সাগরের মাঝখানে দ্বীপ, টিনের ঘরবাড়ি গুলো বাতাসের বেগে লন্ডভন্ড,মাথায় গাছে পড়ে ২০ জনের মৃত্যু, পাহাড় ধসে ৫০০ জনের প্রাণহানি। তুফান থেকে রেহাই পেতে সাইক্লোন সেন্টার ও স্কুলে জায়গা না পেয়ে অনেক মুসলিম দোতলা মন্দিরে আবার অনেক হিন্দু দোতলা মসজিদে।চেয়ারম্যান সাহেবের ও জায়গা হয়েছে পাহাড়ের উপর শিব মন্দিরে। চারদিকে কান্না আর চেয়ারম্যানের চোখে পানি,মনে মনে ভাবতে লাগলো “কয়েকদিন আগে যে মানুষটি এই মন্দির ভাঙ্গার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আজ সে মানুষটাই শিব মন্দিরের বুকে লুকিয়ে আছে”।মসজিদে জায়গা পাওয়া অনেক হিন্দু গর্ভবতী বাচ্চা প্রসব করেছে,আর মসজিদের ঈমাম সে মহিলা গুলোর সেবা করছে। বাকি মুসলমান গুলোও হিন্দু গর্ভবতী মহিলাদের সেবা করছে।আজ তারা মানুষ হয়েছে,হয়েছে সঠিক মুসলিম আর সঠিক হিন্দু। কারন কেউ কাকে হিংসা করছে না। আরেকজনের কষ্টে অন্যজন চোখের পানি ঢালছে। আহা!কিরূপ সৃষ্টার সৃষ্টি,বোঝা বড়ই কঠিন।

তারপর দিন সকাল…

চারদিকে মানুষের লাশ,হিন্দুর বুকে মুসলিম লাশ আবার মুসলিমের বুকে হিন্দুর লাশ শুয়ে পড়ে আছে। আবার অনেকের জাত চেনাও কঠিন হয়ে গেছে।বেঁচে থাকা মানুষ গুলো লাশের দিকে থাকিয়ে ভাবছে আর ভাবছে “কি এতো জাতের ভাগ”

১০০ বছর পর…

২১১৯, এই ১০০ বছরে হিন্দু মুসলিম কোনওদিন বিবাদ লাগেনি।সবাই যে যার মতো ধর্ম পালন করে। কেননা,কেউ ধর্মের ভুল ব্যাখ্যায় কাউকে বলি করে না, কাউকে করে না ছোট। দ্বীপ আছে দ্বীপের মতো,শিব আছে শিবের মতো।

তাই শিবখালী নাম অক্ষত…।

লেখকঃ আর.এইচ. রাকিব
পেশাঃছাত্র
প্রতিষ্ঠানঃ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
বিভাগঃ নৃবিজ্ঞান
জেলাঃকক্সবাজার
উপজেলাঃমহেশখালী

3 COMMENTS

Comments are closed.

error: Content is protected !!
Exit mobile version