Home Islamic বাবাকে নিয়ে টুকরো স্মৃতি

বাবাকে নিয়ে টুকরো স্মৃতি

0

০১. সবুজ গাঁ পেরিয়ে সবুজ ফসলের মাঠের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা রাস্তাটির মোহনায় দাঁড়িয়ে শৈশবে আমরা ভাই-বোন মিলে বাবার বাজার থেকে ফেরার অপেক্ষায় প্রহর গুনতাম। আবার ঈদ উপলক্ষে ভাই -বোন সকলে বাবার হাতধরে সেই রাস্তা দিয়ে শখের কেনাকাটা করতে ছুটে যেতাম রামু চৌমুহনী।

০২. বাবার গড়া সাদাসিদে যে বাড়িতে আমরা বসবাস করে আসছিলাম সেটির সাথেই আমাদের শৈশব-কৈশরসহ দীর্ঘ সময়ের স্মৃতি মিশে আছে। বাড়িটির প্রতিটি গাছ-বাঁশ ও টিনের সাথে মিশে ছিলো আব্বাজানের কষ্ট -সাধনার ঘাম ও ঘ্রাণ। সেই বাড়িটি অতি সম্প্রতি অস্তিত্বহীন হলেও হৃদয়ের আয়নায় এখনো ভাস্বর হয়ে আছে।

০৩. আমাদের বাড়ির চতুর্পাশের সারি সারি সুপারি গাছও আব্বাজানের পরম যত্নে সাজানো। আমাদেরকে যেমন অকৃত্রিম মমতায় লালন- পালন করেছেন তেমনি বাগানের প্রতিটি গাছকেও পরম আদর-যত্নে পরিচর্যা করে আসছেন তিনি। এই বাড়ি, এই বাগান আমাদের মা-বাবার অকৃত্রিম ভালোবাসার নিদর্শন।

০৪. ১৯৯১সালের ২৯ এপ্রিল রাত যতই বাড়ছিলো প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড়ে গতিবেগও দ্রুত বাড়তে লাগলো। তখনো বাবা বাড়ি ফিরেননি! পকুরের পূর্বপাড়ে বাঁশের বেষ্টনী ও কড়ের ছাউনীর ছোট্ট কুটিরে মমতাময়ী আমাদের নিয়ে গভীর শঙ্কায় অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন। আমরা ডাল আর ডিম দিয়ে মায়ের মমতসিক্ত খাবার খাওয়ার এক পর্যায়ে বাইর থেকে মা’র উদ্দেশ্যে বাবার ডাক ভেসে আসলো ‘আমার সন্তানদের নিয়ে তুমি এখনো এই কুটিরে কি করছো! অবস্থাতো মোটেও ভালো না।’ এরপর যে যে অবস্থায় আছি আমাদেরকে কাউকে কাঁধে, কাউকে কোলে করে এমন বিদঘুটে অন্ধকার ও প্রবল বাতাসের মাঝেও বাবা ছুটে চলেছিলেন নির্মাণাধীন বাড়ির দিকে। তখন রাত কয়টা তা আমার মনে নেই।

০৫. আমাদের বাড়ি একেবারে মসজিদের সাথে লাগোয়া। তাই ছোটকাল থেকেই ফজরে বাবার আযানের সুমধুর ধ্বনিতে আমাদের ঘুম ভাঙতো। এভাবে স্বভাবতই একটি দ্বীনি আবহে আমাদের বেড়ে উঠার সুযোগ হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।

০৬. গ্রাম-বাংলার আবহমান ঐতিহ্যধারার এক অনন্য সৌন্দর্যের নাম চাষাবাদ। তেমনই এক আদর্শ কৃষক ও চাষী পরিবারে আমাদের জন্ম। সময়ের আবর্তনে এখন চাষাবাদ না করলেও আমার বাবা একসময় ছিলেন পুরোদস্তুর কৃষক। অত্যন্ত শৌখিন ও পেশাদার কৃষক হিসেবে বাবাকে দেখেছি সেই শৈশব থেকেই। ফজরের নামায পড়েই ভোর বিহানে মা আমাদেরকে কুরআনের পাঠশালা মক্তবে পাঠিয়ে দিতেন আর বাবা ছুটে যেতেন ফসলের মাঠে। এরই মাঝে মা রান্না-বান্নার কাজ সম্পন্ন করে নিতেন। মক্তব ছুটির পর বাড়ি ফিরে আমি ও আমার বড় বোন বাবার জন্য ভাত নিয়ে মাঠে যেতাম। সে সুবাদে দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠে সবুজের সমারোহ, সহজ-সরল কৃষক ও কৃষিজ শ্রমিকদের পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ দৃশ্য দেখে আমাদের মন জুড়িয়ে যেতো। যারা সারাদিন পরিশ্রম করে সকলের মুখে হাসি ফুটাতে ব্যস্ত, সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশধারায় যাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশদারিত্ব রয়েছে
তাদের মধ্যে কৃষক, চাষী, শ্রমিক, মজুর অন্যতম। তাই সেই কচি বয়স থেকে এই পেশা ও সংশ্লিষ্টদের প্রতি একটি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ তৈরি হয়েছিল কৃষক বাবার আদর্শ দেখে।

০৭. আব্বাজানের আপন মামা, আমার দাদীর ছোট ভাই মাওলানা মুহাম্মদ শফী রহ. ছিলেন, কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র জামেয়া দারুল উলুম চাকমারকুলের মুহাদ্দিস। যিনি পরবর্তীতে এ প্রতিষ্ঠানের শায়খুল হাদীস ও নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও অভিষিক্ত ছিলেন। আব্বাজানেরা তাঁকে মৌলভী মামা বলে ডাকতেন আর আমরা ডাকতাম মৌলভী দাদা। শৈশব থেকেই মৌলভী দাদার সুন্নাতী লেবাস-পোশাক ও আমলী জিন্দেগীতে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। আমি হাফেজে কুরআন ও হামেলে কুরআন হওয়ার প্রেরণাও তিনি। আব্বাজানকে প্রায় সময় বলতাম আমি মৌলভী দাদার মত আলিম হব। ইত্যবসরে কোন এক মাদ্রাসার সভায় নাকি আব্বাজান হ্নীলার সদর সাহেব হুজুর রহ. এর ওয়াজ শুনেছেন। সে ওয়াজে তিনি পবিত্র কুরআন মজীদের সূরা শুআরার ৮৮ নং আয়াত উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ” ওই দিবসকে ভয় করো যে দিবসে ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবেনা। আল্লাহর কাছে যে একটি সুস্থ অন্তর নিয়ে যাবে সেই কাজে আসবে। কুরআন-হাদীসের শিক্ষাগ্রহন করে আমলকারীরাই হবেন সেই সুস্থ অন্তরের অধিকারী।” এ গুরুত্বপূর্ণ নসীহত আব্বাজানের হৃদয়ে রেখাপাত করে। ফলে তিনি আরও অনুপ্রাণিত হন আমাকে হাফেজ -আলেম বানানোর ব্যাপারে। সেই অনুপ্রেরণা থেকে মৌলভী দাদা ( মাওলানা মুহাম্মদ শফী রহ.) এর সাথে পরামর্শ করে ১৯৯৪ ইংরেজিতে ৫ ম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষে আব্বাজান আমাকে নিয়ে গেলেন, রামু জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসায়। বাবার হাত ধরে হিফজখানা অভিমুখে এগিয়ে যাওয়ার সেই দৃশ্য এখনো চোখের সামনে ভেসে উঠে।
সেই তখন থেকেই এখনো পর্যন্ত দ্বীনি অঙ্গনে আমার পথচলা ও অভিযাত্রা যেন অব্যাহত থাকে সেজন্য আব্বাজানের নিষ্ঠাপূর্ণ অভিভাবকত্ব, সুদৃঢ় অবস্থান ও কর্মপ্রয়াস ভূয়সী প্রশংসার দাবি রাখে।

আব্বাজান এখনো আমাদের সুখের জন্য নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ আমাদের সুখের জন্য অবিরাম প্রচেষ্টায় মগ্ন থাকেন তিনি। সন্তানের সুখ-শান্তিতেই তিনি খুঁজে ফিরেন আত্মার প্রশান্তি।

আল্লাহ আমার আব্বাজানকে দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন দান করুন।
“রাব্বিরহামহুমা কামা রাব্বায়ানী সগীরা।” আমিন।

লেখক-
সভাপতি, রামু লেখক ফোরাম।

error: Content is protected !!
Exit mobile version