Home Education Magazine আঞ্চলিক গান – মহেশখালীর বিয়ের গান প্রসঙ্গে

আঞ্চলিক গান – মহেশখালীর বিয়ের গান প্রসঙ্গে

0
আঞ্চলিক গান - মহেশখালীর বিয়ের গান প্রসঙ্গে
মইশখালী বিয়ের গান

মহেশখালী (আঞ্চলিক নাম মইশখালী) বিয়ের গান প্রসঙ্গে


বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায় নিজস্ব বিয়ের আঞ্চলিক গান আছে, যেইগুলা তাদের আঞ্চলিকতারে ছাড়াইয়া সার্বজনীন হইতে পারে নাই খুব একটা (সিলেটি একটা বিয়ের গান ” আইলো রে নয়া দামান” ইদানীং ভাইরাল হইছে যদিও)। সার্বজনীন হইতে পারাটাও খুব মহৎ কিছু না, স্বাতন্ত্র্য ধইরা রাখাটা দরকার।

তো, কী ধরনের আঞ্চলিক গান মহেশখালীর বিয়েতে গাওয়া হয় সেইটা বলার আগে মহেশখালীর বিয়ের গানের ধরণটা বইলা রাখলে ভালো হয়। খালি গলায় মাইক্রোফোন দিয়া গাওয়া হয় এই গান। এক বা দুই হাজার টাকায় গান গাওয়ার শিল্পী (স্থানীয়দের ভাষায় শায়ের)  পাওয়া যায় এইখানে। সাধারণত বর পক্ষের লোকেরাই গানের আয়োজন কইরা থাকেন।

এক থেকে দুইদিন পর্যন্ত গানের আসর চলে। সাধারণত এইখানে বিয়ে হয় দিনের বেলায়। ফলে বিয়ের আগের রাতে রাতভর শিল্পী বিয়ের গান গায়৷ বিয়েরদিনও বরযাত্রার গাড়িতে করে মাইকে গান গাইতে গাইতে কনের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করা এই অঞ্চলের একটা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতির অংশ হয়া আছে৷ অনেক সময় এমনও হয় যে, গান গাইতে গাইতে বউ আনতে যায় নাই বইলা কনে পক্ষ কন্যা সম্প্রদান করতে রাজী হয় নাই। আবার মাইক আর শিল্পী নিয়া গিয়া বউ আনতে হইছে।

বিয়ের গানের দুইটা বিরোধী পক্ষও এইখানে দেখা যায়৷ এক হইলো মোল্লা গ্রুপ। যারা বিয়ের গান বন্ধ করার পক্ষে। কিন্তু জোর করে বলতে পারে না যে বন্ধ করতেই হবে। আরেক পক্ষ হইলো রুচিশীল উচ্চশিক্ষিত শ্রেণি। এরা বন্ধ করতে বলে না ঠিক, কিন্তু নিজেদের বিয়েতে এই গানের আয়োজন করে না। তারা এইটাকে নিম্নরুচির অশিক্ষিতদের কাজকারবার বইলাই মনে করে। ফলে এই দুই শ্রেণীর লোক যত বাড়তে থাকবে ‘মইশখাইল্ল্যা বিয়ের গান‘ ততই নাই হয়া যাইতে থাকবে।

তো, মহেশখালী (কক্সবাজার জেলা) বিয়ের গান দিয়া খুবই সমৃদ্ধ একটা অঞ্চল বলা যায়। কেবল নিজস্ব আঞ্চলিক গান বা কেবল বিয়ের গান দিয়াই ভরপুর না, এর লগে প্রচুর পরিমাণে সাবকন্টিনেন্টের ক্লাসিকাল মিউজিক এইখানে গ্রহণ করা হইছে।

বিশেষ কইরা উর্দু গজল, উস্তাদ মেহেদী হাসান আর ম্যাডাম নুর জেহানের; পঞ্চাশ থিকা আশি দশকের লতা মঙ্গেশকার, মান্না দে, শামসাদ বেগমের হিন্দি গান। বাংলা গানের মধ্যে আব্দুল আলীম, মনির খান, অনুপ ঘোষাল, তালাত মাহমুদ, কনক চাপা সহ আরো অনেকে। চাটগাঁইয়া গানের মধ্যে আব্দুর গফুর হালী, আমান উল্লাহ গায়েন আর বুলবুল আক্তার উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও একটা হিন্দুদের শ্যামা সঙ্গীত আছে কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা কুমার সানুর গাওয়া, ‘ আমার স্বাদ না মিটিলো আশা না পুরিলো, সকলি ফুরায়ে যায় মা..‘।

বিয়ের এই আঞ্চলিক গান গুলা মূলত চার ভাগে বিভক্ত।

এক হইলো ‘অঁলা’। অঁলা এক প্রকার চাটগাঁইয়া মোর্চা সংগীত; এমনভাবে এই গীতের সূর সেট করা হইছে যেন ঘন্টার পর ঘন্টা বানিয়ে বানিয়ে গাওয়া যায়। একটা জনপ্রিয় লাইন আছে এমন, ‘ফইরেঘোনা বিলের মাঝে তোতার ঝাঁক বইস্যে, সোনামিয়া দোলা তোতা মাইত্তু গেইয়্যে রে মোর হায় হায় রে…

দ্বিতীয় হইতেছে, ‘চেয়ার‘। এই শব্দটা আসছে শায়েরী থেকে। বিশেষ কইরা উর্দু গজল/শায়ের আর হিন্দি গান গুলা এই পর্যায়ে পড়ে।

তৃতীয় ঘরনা হইতেছে পুরানা বাংলা আর আঞ্চলিক গান।

চতুর্থ হইলো, বিয়ে কেন্দ্রিক বেশকিছু গান। যেগুলা একান্তই এই অঞ্চলের। এইগুলা গায় বিশেষ করে বউ আনতে যাওয়ার মুহূর্তে, যাওয়ার পথে আর বউ নিয়া চইলা আসার সময়।

যেমনঃ দোলার মা দোয়া করো, দুনো হাত তুলিয়া, আজিয়া আরফাত দোলার বিয়া’, ‘ ভাবী চোখে কাজল,ওঠে পালিশ দিয়ে লাল গরি, ধীরে ধীরে চলো রে স্বামীর বাড়ি..’ ‘নায়রী নাইয়র হলো শেষ, এইবার চলো নিজের দেশ'(এইটা যদিও মৃত্যু বিষয়ক গফুর হালির গান, তবুও এর ভাব, কনের স্বামীর বাড়ির দিকে যে যাত্রা, তার সাথেও মিলে যায়৷)

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হইতেছে রবীন্দ্র বা নজরুল সংগীত গুলারে পুরাপুরি এড়াইতে পারছে। এইটা এই কারণে হইতে পারে যে, অই গান গুলা একটা নির্দিষ্ট রুচির বাইরে যাইতে পারে নাই। আমের দুয়ারে যায় নাই রবী গান৷ হিন্দি আর উর্দু গান গুলা কিন্তু সব ক্লাসের সব রুচির কাছেই পৌঁছাইতে পারছে।

মইশখাইল্যা বিয়ের গানের এই ট্রেডিশনটার বয়স পঞ্চাশ বছরের খুব বেশি হয় নাই। যেই গান গুলা এইখানে ঢুকছে এর লগে রেডিওর একটা সংযোগ আছে। এই অঞ্চলে যখন মাইক্রোফোন আসছে নতুন নতুন এবং অই সময়ে রেডিও আর ক্যাসেটে যেই গান গুলার আধিপত্য ছিলো বেশি, এবং সব ক্লাসের লগেই যাইতে পারছে সেই গান গুলা এইখানে ঢুকছে।

এইটা সত্তুর থিকা আশি এই দুই দশকেই বেশি ঘটার কথা। নব্বই দশক আর এই শতকের শূন্য দশকে পূর্ণতা পাইছে পুরাপুরিভাবে। তো, মইশখাইল্যা  বিয়ের এই গান গুলা আর কোন অঞ্চলে গাইতে দেখি নাই তেমন একটা। মানে বিয়েতে, আয়োজন করে গাইতে দেখি নাই। আমার ধারণা, এই গান গুলা একটা সময়ের সাক্ষী হয়া থাকবে মহেশখালীর ইতিহাসে। মহেশখালীর নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ এই গান গুলা।

আমার অনেক গুলা রাতজাগা রাতের স্মৃতি এই গান৷ তো, কয়দিন আগে আমি আর খালিদ ইউটিউব থিকা খুঁজে খুঁজে প্রায় ৫০টা মতো গান কালেক্ট করছি। গুরুত্বপূর্ণ কিছু গানের তালিকা এইখানে রাখলাম; চাইলে সার্চ কইরা দেখতে পারেন ইউটিউবে।

উর্দুঃ

১. ‘Duniya kisi ke pyaar mein / jannat se kam nahin’ -উস্তাদ মেহেদী হাসান।
২. ‘Rafta rafta woh meri hasti ka saamaan ho gayey’ -উস্তাদ মেহেদী হাসান।
৩. ‘ Aaja aaja, aaja meri barbaad mohabbat ke sahaare Hai kaun jo bigdi hui taqdeer sanvaare’ – ম্যাডাম নুর জেহান।
৪. ‘Hina ki khusbo behek rehi hay’ -নুর জেহান।

হিন্দিঃ

১. ‘Na shikwa hai koi na koi gila hai Salaamat rahe tu yeh meri duaa hain’ -লতা মঙ্গেশকার।
২. ‘ Chaman me reh key virana meraa dil hota jata hai’ – শামসাদ বেগম।।
৩. ‘ Milate hi aankhe dil Huaa deewana kisi ka’ -শামসাদ বেগম
৪. ‘Pyar karna thu dharna kya’ – লতা মঙ্গেশকার।
৫. ‘Tuje suraj khahoon ya chanda mera naam’ – মান্না দে
৬. ‘Hawa main udtha jaye mera laal du patta’ -লতা মঙ্গেশকার
৭. ‘Mera dil yeh phukare ajaa’ -লতা মঙ্গেশকার

বাংলাঃ

১. ‘পরের জায়গা পরের জমিন ঘর বানায়া আমি রই, আমি তো সেই ঘরের মালিক নই’ -আব্দুল আলীম
২. ‘কার লাগিয়া গাঁথো ফুলের মালা’ – আব্দুল আলীম
৩. আমার স্বাদ না মিটিলো – কুমার সানু
৪. ‘আসিলেন নবী কামলীওয়ালা রবি আওয়ালের ১২ই তারিখে’ -আমানুল হক চৌধুরী
৫. ‘বিয়ের(জন্মদিনে) দিনে কি আর দেব তোমায় উপহার’ -স্বপন চক্রবর্তী
৬. ‘আমার এই ভালোবাসা জানি গো তোমার ক্ষনিকের ভালো লাগা ভুল’ -অনুপ ঘোশাল
৭. ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো, চাঁদ বুঝি তা জানে’ -সুবির নন্দী, কনক চাঁপা।
৮. ‘নাইয়রী নায়র হলো শেষ, এইবার চলো নিজের দেশ’ -আব্দুল গফুল হালী,নিজাম হাজারী।
৯.’ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না’ -হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
১০. ‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া এত যত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই’ -আব্দুল আলীম
১১. ‘বিচারপতি তোমার কাছে বিচার না পেলে’ -মনির খান।
১২. ‘ভালোবাইসা দিলিরে বন্ধু জ্বালা’
১৩. ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি’ -আব্দুল আলীম

১৪. ‘পূর্ণিমা চাঁদ আর তারার মেলা আকাশে, শুধু তুমি নেই এ সময়’ – সনু নিগম

চাটগাঁইয়াঃ

১. ‘প্রেম ন গরি সুখে আছিলাম নিঠুর বন্ধুর সনে’ -বুলবুল আক্তার।
২. ‘দেহ ছাড়ি প্রাণ গেলেরে আর হন দিন ফিরি আইসতো নয়’ -আব্দুল গফুর হালী।
৩. ‘যাত্তুন যারে ভালা লাগে, হালা অইলেও সুন্দর’ -বুলবুল আক্তার
৪. ‘অরে হালা ভ্রমরা, আই আইজু ফুলর হরা, ইত্তার তুই আরে ন জ্বালাইও’

এগুলা ছাড়াও বিয়ে রিলেটেড অসংখ্য গান মইশখাইল্যা বিয়েতে গাওয়া হয়া থাকে।

তো বন্ধুরা মহেশখালীর বিয়ের গান এবং ঐতিহ্য নিয়ে আপনার মতামত কি তা নিচে কমেন্ট করে জানান। এবং অবশ্যই আপনাদের এলাকায় কোন ধরনের আঞ্চলিক গান গাওয়া হয় তা জানাতেও ভুলবেন না যেন।

error: Content is protected !!
Exit mobile version