Monday, October 7, 2024
HomeEditorialড. সলিমুল্লাহ খান-জ্ঞান তাপস ও বরেণ্য গবেষক

ড. সলিমুল্লাহ খান-জ্ঞান তাপস ও বরেণ্য গবেষক

আমাদের মহেশখালীতে একজন সলিমুল্লাহ খান আছেন,যার নাম একটা ব্র‍্যান্ড। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও যার সুখ্যাতি।জ্ঞানের ভান্ডার, জ্ঞানের সাধক, জীবন্ত এক কিংবদন্তি,অনেকে তাঁকে ডাকেন জীবন্ত লাইব্রেরী,আজকে এই জ্ঞান তাপস কে একটু জানার চেষ্টা করবো…

জন্ম পরিচয়:
সলিমুল্লাহ খান ১৯৫৮ সালের ১৮ আগস্ট কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার সিপাহির পাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মহেশখালীতে বেড়ে ওঠেন।তার বাবা ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। তারা পাঁচ ভাই তিন বোন। সলিমুল্লাহ খান চতুর্থ। বড় তিন ভাই ও ছোট তিন বোন। তার নানাবাড়ি কালারমার ছড়া,মহেশখালী,কক্সবাজার।

শিক্ষাজীবন:
সলিমুল্লাহ খান চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পাস করেন। এরপর ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। এখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায়, ১৯৭৬ সালে আহমদ ছফার সাথে সলিমুল্লাহ খানের পরিচয় হয়। আহমদ ছফার মাধ্যমে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাথে পরিচয় হয় সলিমুল্লাহ খানের।এ পর্যায়ে কিছু সময়ের জন্য তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ছাত্র শাখার সাথে জড়িত ছিলেন।যুক্তরাষ্ট্রে নিউ ইয়র্কের দ্যা নিউ স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দীর্ঘ কাল অধ্যয়ন ও গবেষণা করেন। এখানে তার সর্বশেষ অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিলো “ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং তত্ত্ব, ১৭৯৩-১৮৭৭।” এ অভিসন্দর্ভের জন্য তাকে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়।

কর্মজীবন:
১৯৮৩-৮৪ সালে সলিমুল্লাহ খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।পরবর্তীকালে ১৯৮৫-৮৬ মেয়াদে অল্প দিনের জন্য ঢাবি’র ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটতে শিক্ষকতা করেন। ১৯৮৬ সালে বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান পড়াশোনা করতে। দীর্ঘ কাল তিনি নিউ ইয়র্কে অবস্থান করেন।
১৯৯৯ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এখানে তিনি অর্থনীতি পড়াতেন। একই সঙ্গে আইন ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে নিয়ে তিনি কিছু দিন তিনি ঢাকা হাই কোর্টে যাতায়াত করেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন এবং স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি ঢাকার স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি তে আইন বিভাগের একজন অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

পরবর্তীকালে সলিমুল্লাহ খান ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ -এ অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি বর্তামনে সেন্টার ফর এডভান্সড থিওরির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সাথে জড়িত।
যেমনঃ এশিয়ান শিল্প ও সংস্কৃতি কেন্দ্র, আহমেদ ছফা রাষ্ট্রসভা ইত্যাদি।

কর্ম ও তৎপরতা:
কর্মজীবনের শুরুর দিকে সলিমুল্লাহ খান আব্দুর রাজ্জাকের বিখ্যাত বক্তব্যের ওপর একটি বই লেখেন। বইটির নাম “বাংলাদেশ: স্টেট অব দ্য নেশন”। ১৯৮১ সালে বইটি প্রকাশিত হয়।আহমদ ছফা তার এই বইয়ের সমালোচনা করেন। আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে সলিমুল্লাহ খানের মূল্যায়ন ঠিক নয় বলে মনে করেন তিনি।সলিমুল্লাহ খান প্র্যাক্সিস জার্নাল নামে একটি সাময়িকী সম্পাদনা করতেন ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৬/৮৭ সাল পর্যন্ত।

তিনি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক পর্যায়ের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সমালোচনা করেন।তার সমালোচনার ভিত্তি হল মার্কসবাদী তত্ত্ব।তিনি উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনের তাৎপর্য তুলে ধরেন এবং পশ্চিমা হস্তক্ষেপের নিন্দা করেন।পশ্চিমা চিন্তাধারা ও বক্তব্যকে ঔপনিবেশিক এবং সাম্রাজ্যবাদী লিগ্যাসির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেন।এই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি শার্ল বোদলেয়ার,ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, মিশেল ফুকো, ফ্রানৎস ফানোঁ লেভি স্ত্রস, এডওয়ার্ড সাইদ,তালাল আসাদ এবং অন্যান্যদের ওপর লেখালেখি করেছেন।

বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি তার লেখার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। তিনি লালন শাহ,রামপ্রসাদ চন্দ্র, জসিমউদ্দীন, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, আহমদ ছফা, আবুল হাসান, চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং তার কিছু সমসাময়িক ব্যক্তিদের নিয়ে লিখেছেন। বাংলা শব্দপ্রকরণের নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির ওপর সমালোচনা করেছেন।তিনি বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিকভাবে ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি দেখান।বাংলাদেশের উচ্চ শ্রেণীর লোকদের বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ করেন।তিনি উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার সমর্থক।২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সরকার কওমী মাদ্রাসার দাওরা ডিগ্রিকে মাস্টার্স সমমান দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সলিমুল্লাহ খান এই কাজের প্রশংসা করেন।বাংলাদেশে কীভাবে বাংলা ভাষার মাধ্যমে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে, তা নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন।

তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে একটি ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী ও গণতান্ত্রিক চিন্তা লালিত কবি হিসেবে তুলে ধরেন। তার বই আহমদ ছফা সঞ্জীবনী আহমদ ছফার কাজের অকপট মূল্যায়ন।বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ হিসেবে উল্লেখ করেন, যিনি কাজী নজরুলের দর্শনের যথার্থ উত্তরাধিকারী।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে আহমদ ছফার লেখাগুলো সংগ্রহ করে তিনি তা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন।

বেহাত বিপ্লব ১৯৭১ বই এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কৌশলগত ও রাজনৈতিক দিক বিশ্লেষণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক তিনটি নীতি হিসেবে তিনি বলেন, “সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার”। ২০১১ সালে bdnews24.com একটি বিতর্কের আয়োজন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র মেহেরজান নিয়ে তিনি সমালোচনা করেন।শাহবাগ আন্দোলনের সময় সলিমুল্লাহ খান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষ নিয়ে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন।মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কেও তিনি হস্তক্ষেপ করেছেন।

সাম্প্রদায়িকতা ও চরমপন্থা নিয়ে সলিমুল্লাহ খান ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন ভারতে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ে।সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা করেন এবং প্রস্তাব দেন সামাজিক ন্যায়বিচার সমুন্নত করার, যা সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করতে পারে। সব সম্প্রদায়ের নিজ নিজ ধর্ম পালনের সমান অধিকার নিয়ে কথা বলেন।

তিনি প্লাতোন, জেমস রেনেল, শার্ল বোদলেয়ার, ফ্রানৎস ফানোঁ, ডরোথি জুল্লে প্রমুখের লেখা বাংলায় তর্জমা করেছেন।
সলিমুল্লাহ খান বহুভাষী। ২০০৫ সাল থেকে তিনি বাংলা সাধু ভাষায় লেখালিখি করছেন।
তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশন টকশো এবং বিতর্ক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকেন।(সুত্র:উইকিপিডিয়া)

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশীল শিক্ষকরা আমাকে চাকরি দেয়নি। বলেছিল, ‘একে চাকরি দেওয়া যাবে না, এছেলে মৌলবাদী।’ কারণ, আমি ‘লজ্জা’ না বলে ‘শরম’ বলেছিলাম।” — সলিমুল্লাহ খান

ঐসুশীল বাবুগুলো আজ হারিয়ে গেছে, আপনি রয়ে গেছেন দেশ প্রেমীদের হৃদয়ে।
জ্ঞানের জগতে অনুকরণীয় আদর্শ, বর্তমান উপমহাদেশে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতিফলন আমাদের সলিমুল্লাহ খান স্যার।

ওনাকে জন্মদিনে উৎসর্গ করে আবুল সরকার চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় লিখেছেন…

“শুভ জন্মদিন হে শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশি।

গেয়ার মাডির এএন ফোয়া
গেয়ার দেশের এএন সাহসী,সত্য চাষি
বাংলাদেশে এএন মুখ আরত ন দেখি
কেয়নে ন কওইর পারির
গেয়ার মাডির এএন ফোয়া
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশি।
তার ঐ তীক্ষ্ণ চঁচু
করে চলেছে এই জাতির চক্ষু সুচারু অপারেশন
তুলে নিয়েছে এমন করে এই জাতির আঁখি কোনের ছানি
সর্ব কালের শ্রেষ্ঠ ophthalmology
কেনা এখন মোরা দেখতে পাই ফকফকা সত্য ইতিহাস।
গেয়ার মাডির এএন ফোয়া
গেয়ার দেশের এএন সাহসী,সত্য চাষি
বাংলাদেশে এএন মুখ আরত ন দেখি
কেয়নে ন কওইর পারির
গেয়ার মাডির এএন ফোয়া
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশি।
আজি এমন দিনে আমার মনের ইউনিভার্সিটি
দিচ্ছি তোমায় এই সম্মান
স্যার সলিমুল্লাহ খান
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশি
শুভ জন্মদিন হে শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশি।”

যার বক্তব্য শুরু হলে শেষ না করে কেউ উঠতে পারে না। তার শক্রও তার বক্তব্য শুনতে শুরু করলে শত্রুতা ভুলে মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে থাকে।
~
সলিমুল্লাহ খান স্যার নিয়ে Mohammed Siddik লিখেছেন,,,

“গুরুর সমীপে

বার্ধক্য ঝং ধরায় নি যার জ্ঞানের শহরে,
কতশত নিভন্ত প্রদীপ প্রতিক্ষিত,
তার জ্ঞানের আলোর ঝলকানি পেতে।
উদ্দীপিত হাজারো প্রাণ মুগ্ধতায় খোঁজে,
কি এমন জাদুকরী গুণ আছে তার ভাষণে?
ইতিহাস যেন প্রস্ফুটিত হয় তার প্রতিটি লেখনিতে,
সে যেন পুরো জাতিকে ইতিহাস চেনায় হাতে ধরে।
শ্রুতিমধুর বাণীতে সে প্রাণ ফেরায় অর্ধমৃতের দেহে,
কতশত দর্শকের মন কেড়েছে সে তার প্লবতার হাসিতে।
এমন মহামানবের পদধূলি পেতে অপেক্ষমান হৃদয়ে,
সহস্রাধিক বছর পাড়ি দিতে রাজি এই অধম শিষ্য।
হাজারো শিষ্যের হৃদকম্পনে প্রতিধ্বনিত্ব হওয়া কথাগুলোকে,
এই অধম শিষ্য সমর্পণ করেছে।

শুভ জন্মদিন গুরু ❤
সলিমুল্লাহ খান – Salimullah Khan”

–১৭ আগস্ট সলিমুল্লাহ খানের জন্মদিন–
আর আমি বলি এটা একটা ঐতিহাসিক তারিখ,এবং একটা ইতিহাসও বটে আমাদের জন্য এবং বাংলাদেশীদের জন্য।

শুভ জন্মদিন লেখক-গবেষক-বুদ্ধিজীবী ড.সলিমুল্লাহ খান স্যার।

আজকের এই দিনে স্যারের দীর্ঘায়ু ও সু-সাস্থ্য কামনা করছি।

সংরক্ষন ও পরিমার্জনে…
মোসলেম উদ্দিন
শিক্ষার্থী,ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Related News
- Advertisment -

Popular News

error: Content is protected !!