ইতিকাফের ফজিলত সম্পর্কে আমাদের আজকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা – মুসলমানদের জন্য রমজান মাস হলো শ্রেষ্ঠ নেয়ামতের মাস। এই রমজান মাসের ফজিলতপুর্ন ইবাদতগুলোর মধ্যে অন্যতম ইবাদত হলো ইতিকাফ। নবী করিম (সা.) ইতিকাফের এত বেশি গুরুত্ব দিতেন যে কখনো তা ছুটে গেলে ঈদের মাসে আদায় করতেন।
ইতিকাফের আভিধানিক অর্থঃ
আটকে পড়া,থেমে পড়া,কোনোকিছুতে এঁটে থাকা ও তার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলা।
শরয়ী পরিভাষায় ইতিকাফঃ
আল্লাহ তাআলার ইবাদতের উদ্দেশ্যে মসজিদে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলা।
ইতিকাফের উদ্দেশ্যঃ
লাইলাতুলকদর তালাশ করা। লাইলাতুল কদর তথা উত্তম রাত যে রাতে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল সেই রাতকে তালাশ করা।
ইতিকাফের প্রকারভেদঃ
ক) সুন্নাত ইতিকাফঃ
রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ। অর্থাৎ ২০ রমজানের সূর্য ডোবার আগ মুহূর্ত থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত মসজিদে ইতিকাফ করা। এ ধরনের ইতিকাফকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া বলা হয়। গ্রাম বা মহল্লাবাসীর পক্ষে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি এই ইতিকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে।
খ) ওয়াজিব ইতিকাফঃ
মানতের ইতিকাফ ওয়াজিব। যেমন কেউ বলল যে, আমার অমুক কাজ সমাধা হলে আমি এত দিন ইতিকাফ করব অথবা কোনো কাজের শর্ত উল্লেখ না করেই বলল, আমি এত দিন অবশ্যই ইতিকাফ করব। যত দিন শর্ত করা হবে তত দিন ইতিকাফ করা ওয়াজিব। ওয়াজিব ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। সুন্নাত ইতিকাফ ভঙ্গ করলে তা পালন করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
গ) নফল ইতিকাফঃ
সাধারণভাবে যেকোনো সময় ইতিকাফ করা নফল। এর নির্ধারিত কোন মেয়াদ নেই। অল্প সময়ের জন্যও ইতিকাফ করা যেতে পারে। সাওম পালন করা শর্ত নয়।
রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাতঃ
রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি বছর অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. হতে বর্নিত,
أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الْأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ، حَتّى تَوَفّاهُ اللهُ عَزّ وَجَلّ، ثُمّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ.
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। নবীজীর পর তাঁর স্ত্রীগণও এটি আদায় করতেন। (সহীহ মুসলিম-১১৭২; সহীহ বুখারী-২০২৬)
হযরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্নিত,
كَانَ يَعْرِضُ عَلَى النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ القُرْآنَ كُلّ عَامٍ مَرّةً، فَعَرَضَ عَلَيْهِ مَرّتَيْنِ فِي العَامِ الّذِي قُبِضَ فِيهِ، وَكَانَ يَعْتَكِفُ كُلّ عَامٍ عَشْرًا، فَاعْتَكَفَ عِشْرِينَ فِي العَامِ الّذِي قُبِضَ فِيهِ.
জিবরাইল (আ) প্রতি বছর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একবার কুরআন শোনাতেন। কিন্তু যে বছর তাঁর ওফাত হয় সে বছর দুই বার শোনান। রাসুল (সা) প্রতি বছর দশ দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু ইন্তেকালের বছর তিনি বিশ দিন ইতিকাফ করেন। (সহীহ বুখারী-৪৯৯৮, ২০৪৪)।
ইতিকাফের সময়ঃ
রামাদানের ২০ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে শুরু হয় এবং ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথে শেষ হয়। তবে উত্তম হলো ঈদের দিন সকালে ইতিকাফ থেকে বের হওয়া।
নারীদের ইতিকাফঃ পুরুষদের ন্যায় নারীদের জন্য ইতিকাফ সুন্নত। কিন্তু তারা ঘরে ইতিকাফ করবে। ইতিকাফের জন্য ঘরের নির্দিষ্ট নামাজঘরকে ব্যবহার করা যেতে পারে। কারো নামাজের জন্য নির্দিষ্ট নামাজঘর না থাকলে নামাজের নির্দিষ্ট স্থানকে কাপড় দিয়ে ঘেরাও করে নেওয়া যেতে পারে।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষের দশকে ইতিকাফ করেছেন ইন্তেকাল পর্যন্ত। এরপর তাঁর স্ত্রীরা ইতিকাফ করেছেন।
ইতিকাফে করণীয়ঃ
ইতিকাফে করণীয় হচ্ছে-
১. বেশি বেশি আল্লাহর জিকির-আজকার করা,
২. নফল নামাজ আদায় করা,
৩. কোরআন তেলাওয়াত করা,
৪. দ্বীনি ওয়াজ-নসিহত শোনা ও
৫. ধর্মীয় গ্রন্থাবলী পাঠ করা।
ইতিকাফে বর্জনীয়ঃ
ইতিকাফে যেসব কাজ বর্জনীয়-
عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّهَا قَالَتِ السُّنَّةُ عَلَى الْمُعْتَكِفِ أَنْ لاَ يَعُودَ مَرِيضًا وَلاَ يَشْهَدَ جَنَازَةً وَلاَ يَمَسَّ امْرَأَةً وَلاَ يُبَاشِرَهَا وَلاَ يَخْرُجَ لِحَاجَةٍ إِلاَّ لِمَا لاَ بُدَّ مِنْهُ وَلاَ اعْتِكَافَ إِلاَّ بِصَوْمٍ وَلاَ اعْتِكَافَ إِلاَّ فِي مَسْجِدٍ جَامِعٍ .
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ই‘তিকাফের জন্য সুন্নাত এই যে, সে যেন কোন রোগীর পরিচর্যার জন্য গমন না করে, জানাযার নামাযে শরীক না হয়, স্ত্রীকে স্পর্শ না করে এবং তার সাথে সহবাস না করে। আর সে যেন বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদ হতে বের না হয়। রোযা ব্যতীত ই‘তিকাফ নেই এবং জামে মসজিদ ব্যতীত ই‘তিকাফ শুদ্ধ নয়। (আবু দাউদঃ২৪৬৫)
১. ইতিকাফ অবস্থায় বিনা ওজরে মসজিদের বাইরে যাওয়া,
২. দুনিয়াবি আলোচনায় মগ্ন হওয়া,
৩. কোনো জিনিস বেচাকেনা করা,
৪. ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ করা,
৫. ওজরবশত বাইরে গিয়ে প্রয়োজনাতিরিক্ত বিলম্ব করা ও
৬. স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করা। আল্লাহ তাআলা বলেন:
( وَلَا تُبَٰشِرُوهُنَّ وَأَنتُمۡ عَٰكِفُونَ فِي ٱلۡمَسَٰجِدِۗ)
{আর তোমরা মাসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ো না।}
[সূরা আল বাকারা:১৮৭]
এসব কাজ করলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়। তাই ইতিকাফের সঠিক নিয়ত ও ইতিকাফের ফজিলত এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে জানা আমাদের দরকার।
সর্বোপরি, ইসলামে ইতিকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র মাহে রমজানে ইতিকাফ করার মাধ্যমে তার নৈকট্য লাভের তাওফিক দান করুন (আমিন)।
পাঠক ইতিকাফের ফজিলত নিয়ে আমাদের আজকে লেখাটি আপনাদের কেমন লেগেছে জানাতে ভুলবেন না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে নেক হায়াতে তায়্যেবা দান করুক। (আমীন)
লেখকঃ মোঃ সাইফুল ইসলাম
প্রাক্তন শিক্ষার্থী- ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।