Thursday, March 28, 2024
HomeSportsবাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ধারাবাহিক ব্যর্থতা কেন? উত্তরণের পথই বা কি?

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ধারাবাহিক ব্যর্থতা কেন? উত্তরণের পথই বা কি?

টাইগার ক্রিকেটঃ ধারাবাহিক ব্যর্থতা কেন? উত্তরণের পথই  বা কি?

দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বর্তমানে অবস্থান করছে শ্রীলংকায়। সাম্প্রতিক নিউজিল্যান্ড সফর ও এরও আগের কয়েকটা সিরিজে ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে দেশের ক্রিকেট অনুরাগীদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম হতাশা। শ্রীলংকায় সিরিজেও অস্বাভাবিক কিছু ঘটবেনা বলেই ভক্তদের বিশ্বাস এবং সে কারণেই শ্রীলংকায় থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ভক্তরা এখন বেশি আগ্রহী বরং দেশের ২ জন  ক্রিকেট তারকার অংশ নেওয়া আইপিএল’র দিকে। কিন্তু, দেশের ক্রিকেটের এমন হতাশাজনক চিত্র কেনই বা তৈরি হলো? ময়নাতদন্ত করলে কিছু বিষয় অগ্রাহ্য করার হয়তো সুযোগ নেই।

দুর্বল অবকাঠামো ও ম্যাচহীনতা

ঢাকা এবং চট্রগ্রামের কথা বাদ দিলে দেশের অন্যান্য মাঠ ও মাঠ সংশ্লিষ্ট ড্রেসিং রুম, জিমনেশিয়াম প্রভৃতির অবকাঠামো অনেকাংশেই নিম্ন মানের। মাঠের পরিচর্যা বিশ্বমানের না হওয়ায় প্রথম শ্রেণী ও লিস্ট-এ ম্যাচ খেলে অন্যান্য দেশের মতো মানসম্পন্ন ক্রিকেটার বেরিয়ে আসতে পারছেনা। এছাড়া, গত ১ বছর ধরে করোনার কারণে দেশের ক্রিকেটে খুব একটা ম্যাচও হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে সীমিত পরিসরে কিছু ম্যাচ হলেও ক্রিকেটারদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও ফিটনেস বিকাশের জন্য তা কতটুকুই বা সহায়ক ছিলো!

তাই, বেশি বেশি ম্যাচ আয়োজন ও ঢাকা- চট্রগ্রামের বাইরে অন্যান্য মাঠগুলোতে ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর বিকল্প যেমন নাই, তেমনি মাঠের পরিচর্যা চালিয়ে যেতে হবে নিয়মিত।

দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার অভাব

যেকোনো নতুন সিরিজ আসলেই নতুন নতুন ক্রিকেটারদের সিলেকশন করা হচ্ছে আর মাঠে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে করে এই নবীন ক্রিকেটাররা তাৎক্ষনিকভাবে মনে মনে খুশি হলেও, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে খেলার চাপ নিতে না পেরে বাজে পারফর্মেন্সের কারণে তারা দ্রুত বাদও পড়ছে এবং ১০/১৫ বছর ধরে ক্রিকেটার হওয়ার জন্য যে অমানুষিক শ্রম ও অধ্যবসায় তারা করে এসেছে তার ষোলোকলা পূর্ণ হওয়ার আগেই ক্যারিয়ারের যবনিকাপাত হয়ে যাচ্ছে; যা দেশের ক্রিকেটের জন্য ভবিষ্যৎ হুমকি। তাই, ঘন ঘন ক্রিকেটার বদলী না করে পর্যায়ক্রমে সুযোগ দিতে হবে, সময় দিতে হবে। প্রয়োজনে ব্যাটিং অর্ডার/ বোলিং অর্ডার/ ফিল্ডিং পজিশন পরিবর্তন করেও দেখা যেতে পারে।

 

বিসিবিকে ৫ বছর, ১০ বছর, ২০ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা করে এগুতে হবে। স্কুল ক্রিকেট প্রতিবছর আয়োজন করতে হবে। সেখান থেকে প্রতিবছর ২০-৫০ জন প্রতিভা বাছাই করে বিসিবির তত্ত্বাবধানে ঢাকার নামী ক্লাবগুলোর সাথে এই খুদে ক্রিকেটারদের সংযুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে অস্ট্রেলিয়া- ইংল্যান্ডের নামী ক্রিকেট একাডেমীগুলোর সাথে বিসিবি ওয়ান- টু -ওয়ান চুক্তি করে এই খুদে ক্রিকেটারদের সেখানে ২-৩ বছরের কোর্সের জন্য পাঠাতে পারে। আবার, বিসিবি চাইলে বিদেশ থেকে হাই প্রোফাইলড কোচ এনেও খুদে ক্রিকেটারদের দীর্ঘ মেয়াদী কোচিং করাতে পারে।

মাঠের বাইরের রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব

দলের নিউজিল্যান্ড সফরকালীন সাকিবের বিসিবি প্রেসিডেন্ট হওয়ার মনোবাসনা ও অবসর নিয়ে মাশরাফির ক্ষুব্ধ ঠোঁটকাটা বক্তব্য কিছুদিন ক্রিকেট পাড়ায় উত্তাপ ছড়িয়েছে; এতে কোন সন্দেহ নাই। এসব বিষয় গৌণভাবে হলেও মাঠের ক্রিকেটে প্রভাব ফেলে। জুনিয়র ক্রিকেটারদের মনে সিনিয়র ক্রিকেটারদের অসম্মানজনক বিদায়ের তথ্যগুলো যখন প্রবাহিত হয় তখন তারা তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং এটি মাঠের পারফর্মেন্সে প্রভাব ফেলে। আর সেখানে দলটি যদি বাংলাদেশের মতো আধা- পেশাদার দল হয়, তাহলে তা হয় অবশ্যম্ভাবী। যে কারণে ম্যচের ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে।

তাই, বিসিবির উচিত হবে এধরণের অনভিপ্রেত ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সেদিকে নজর দেওয়া। সে লক্ষ্যে বোর্ডের পেশাদারিত্ব বাড়াতে হবে। কর্মকর্তাদের কথা- বার্তায় স্বচ্ছতা থাকতে হবে। ক্রিকেটারদের মত প্রকাশের সুযোগ থাকাও বাঞ্ছনীয়। এতে করে ক্রিকেটারদের সাথে বিসিবির দুরত্ব কমবে।

ব্যাটিং – ফিল্ডিং এর যাচ্ছে তাই অবস্থা

নিউজিল্যান্ড সফরে প্রতিটি ম্যাচেই দলের ফিল্ডিং এর অবস্থা দেখে খুবই মর্মাহত হয়েছি। মাঝেমাঝে মনে হচ্ছিলো, আমরা যখন পাড়ার ক্রিকেট খেলতাম সেই কৈশোরে তখন আমরাও এমন এমন সহজ ক্যাচ হাতের তালুবন্দি না করে ছেড়ে দেইনি। দলে ফিল্ডিং কোচ আছে কিনা সে প্রশ্নও মনের গভীরে উকি দিয়েছে। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে খেলা ক্রিকেটারদের নতুন করে ক্যাচ প্র্যাকটিস করানোর প্রয়োজনই বা কি! প্রতিটি ক্রিকেটে ন্যাশনাল টিমে চান্স পাওয়ার আগে কমসে -কম ১০ বছর খেলেছে। এসময় তিনি কম হলেও ২-৩ হাজার ক্যাচ লুফেছেন। হটাত করে এই হতচ্ছাড়া অবস্থা হলো কি করে যে, ক্যাচ নেওয়ার সময় তাঁদের হাত – পা কাঁপছে , চোখে ঝাপসা দেখছে! তাহলে সমস্যা কি মানসিক? এটিরও চুলচেরা বিশ্লেষণ হওয়া উচিত।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ফিল্ডারদের আরেকটি দুর্বলতা হলো কাভার, মিড অন, মিড অফ, গালি, ডিপ মিড উইকেট প্রভৃতি জায়গাগুলোতে ফিল্ডাররা এক টাচে বল তালুবন্দি করতে পারছেনা। এতে দেখা যাচ্ছে, যে ডেলিভারিতে রান হওয়ার কথা ছিলোনা সেটিতে বিপক্ষের ব্যাটসম্যান ১ রান নিয়ে নিচ্ছে। আবার, যেখানে ১ রান হওয়ার কথা সেখানে ২ রান নিয়ে নিচ্ছে। এতে করে ইনিংস প্রতি ৩০-৪০ রান অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে, যা সহজে খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না এবং সেটিই দিন শেষে ব্যবধান গড়ে দিচ্ছে।

একারণে পেশাদার ক্রিকেট টিমের মতো এক টাচে বল তালু বন্দি করা এবং দ্রুত উইকেট কিপিং বা বোলিং প্রান্তে বল ছুঁড়ে দেওয়ার প্র্যাকটিস বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ক্রিকেটারদের বেশি বেশি করতে হবে।

সীমিত ম্যাচ উইনারের সংখ্যা

ভারত, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলগুলোর সাফল্যের দিকে আমরা তাকালে দেখতে পাই, ওদের প্রতি ম্যাচে ৪-৫ জন ম্যাচ উইনার থাকেন যারা দলের পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী খেলতে পারে, মুহূর্তেই ম্যাচের ভাগ্য ঘুরিয়ে দিতে পারে। এরা কখনও টেস্ট মেজাজে, কখনও হার্ড হিটার বা পাওয়ার হিটার হিসেবেও ম্যাচের গতি ঘুরিয়ে দিয়ে ফলাফল নিজের ঘরেই তুলতে পারে। আমাদের সেরকম ম্যাচ উইনারের সংখ্যা সীমিত। একসময় আফতাব আহমেদ ছিলেন, বিসিসিআই অননুমোদিত আইসিএলে খেলে তাঁর ক্যারিয়ার শেষ। বাংলার ক্রিকেটের ব্যাডবয় খ্যাত নাসির হোসেনও মাঠের বাইরের বিভিন্ন বিতর্কিত ঘটনায় দলে এখন ব্রাত্য। সাব্বির রহমানও প্রমাণ করতে পারেননি নিজেকে। হালের যারা আছে তাঁদের মধ্যে লিটন দাস মোটামুটি ধারাবাহিক হলেও সৌম্য সরকারের ধারাবাহিকতা নিয়ে হয়ত স্বয়ং বিধাতাও নারাজ!

তাই, দলে পাওয়ার হিটারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। দলের রানিং ক্রিকেটারদের যাদের হাত খুলে মেরে খেলার ইচ্ছা বা অভ্যাস আছে তাদেরকে স্বাধীনভাবে খেলতে দিলে এবং নিয়মতি পাওয়ার হিটিং এর প্র্যাকটিস করালে তারাও হয়ে উঠতে পারে দলের ভবিষ্যৎ এবিডি, ম্যাক্সওয়েল কিংবা রোহিত শর্মা।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ক্রিকেটারদের মানসিক ঘাটতি

হারার আগেই মনে মনে হেরে যাওয়া, নিউজিল্যান্ড কন্ডিশন বলে আগে থেকেই মনের মধ্যে অস্বস্তিবোধ করা এসব আলামত ক্রিকেটারদের শারীরিক ভাষায় পরিলক্ষিত হয়েছে। সৌম্যের ফুট-ওয়ার্কে স্কিল ঘাটতি লক্ষ্যণীয়। এসবই ক্রিকেটারদের মানসিক অস্থিরতার কারণ। এ অবস্থা নিরসনে অভিজ্ঞ মনোবিদের মাধ্যমে ক্রিকেটারদের নিয়মিত মানসিক চেকআপ ও কাউন্সেলিং করানো যেতে পারে। চাইলে ক্রিকেটাররা স্বপ্রণোদিত হয়ে মেডিটেশনের অভ্যাসও গড়তে পারে।

 

দল হয়ে না খেলা/ টিম স্পিরিটে ঘাটতিঃ

দলে ক্রিকেটারদের পেশাদারিত্ব বাড়াতে হবে। শুধু নিজেকে দলে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে না খেলে দলের চাহিদা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলার অভ্যাস গড়তে হবে।  তাহলে, টাইগার ক্রিকেট টিম সত্যিকার অর্থেই দল হয়ে উঠবে এবং সেই দল বিশ্বকাপটাও একদিন ঘরে তুলতে পারবে।

 

 

সাধু ফকির

উন্নয়ন কর্মী, আধ্যাত্মিক বক্তা ও ক্রিকেট বিশ্লেষক ( সাবেক আম্পায়ার বিসিবি)

Related News
- Advertisment -

Popular News

error: Content is protected !!