চৈত্রের খাঁখাঁ রোদ। জাহান্নামের আগুনের চেয়ে গরম ঠেকছে। বদল মিয়ার শরীর থেকে যে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে তার প্রতিটি ফোঁটা প্রতি মণ নুনের চেয়েও দামি বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। পেটের দায় যদি না থাকতো; ঘরে যদি পোয়াতি বউ না থাকতো বদল মিয়া কখনোই চৈতের এই রোদে পুড়ে, পাছায় লুঙি গোছা দিয়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ‘ডংকিলে'(পানি সেচবার কাঠের যন্ত্র,চট্টগ্রাম্য ভাষায় ডংকিল) পানি সেচতো না।
পানি সেচতে সেচতে একটু দূরে ধবধবে সাদা একশ মণি লবণের যে স্তুপটা রয়েছে তার দিকে তাকিয়ে তার সব দুঃখ চলে যায়। তখন তার বউয়ের কথা মনে পড়ে, ওই ধবধবে নুনের মতোই তার চেহারাখানা। আহা কি মায়া মাখানো! সন্ধ্যাকালে ঘরে ফিরে লবণের স্তুপের মতো বউয়ের মুখের দিকে তাকালেও বদল মিয়ার সব দুঃখ চলে যায়। ক্লান্ত হয়ে এলিয়ে দেয় শরীর; পরম মমতায় বউ তার গা মালিশ করে দেয়।
মুহূর্তেই বদল মিয়ার মন খারাপ হয়ে যায়। একটু দূরে কাজ করছিলো সোনা মিয়া। বদল মিয়া বললো, “অ সোনা মিয়া, আমজাইত্তের চামচারা তো আইবো আইজকে।হালারা যে মাপা মাপে ১০০ মণরে তো ৮০মণ কইরা ফালায়। মন চায় হালাগোরে কোপাই।” বদল মিয়া আর সোনা মিয়া শেয়ারে পাঁচ কানি জমিন বর্গা চাষ করছে আমজাদ হোসেনের কাছ থেকে। তার লোকেরা এসে একটু পরে বদল মিয়ার ধবধবে লবণ গুলো নিয়ে যাবে। বাজার দাম যদি হয় ৫০০ টাকা, তাইলে বর্গা চাষিরা পায় ৪০০ দরে। তার উপর যেভাবে মাপে তাতে ১০০ মণ লবণ হয়ে যায় ৮০ মণ। সেই লবণে আমজাদ হোসেন পায় ৪০ মণ, আর দুই মিয়া পায় ২০ মণ করে। তাও টাকা দিতে ঘুরায় ৫/৬দিন। পলিথিন আর বহণ খরচও তাদের ওপর। তার জন্য টাকা কাটা যায় দুই হাজার টাকা। তারা পায় ছয় হাজার করে।কত কষ্টের টাকা! আহা! সাদা সোনা মানেই যেন দরিদ্র কৃষকের আর্তনাদ।
সোনা মিয়া রুক্ষ স্বরে জবাব দেয়, “কি করনের আছে আমাগোর, আমরা হইলাম গিয়া বর্গা চাষা, ছাগলের তিন নম্বর বাইচ্চা। সারা দিন খাটনি খাটমু, পিছে পিছে দৌড়ামো মাগার দুধ পামু না।”
“মন চায় চামচার বাচ্চাগো….. ঐ দেখ আসতাছে। লইয়া যাইবো আমাদের সাদা সোনা, লইয়া যাইবো! টাকা দেওনের বেলায় পিছে পিছে ঘুরাইবো ৫/৬দিন। খানকিরপো!”
আমজাদের লোক ইয়াসিনসহ আরো দশ জন বহণকারী এসে হাজির হলো। লবণের স্তুপের দিকে থাকিয়ে ইয়াসিন বললো, “কি খবর বদল মিয়া? মাইন্সে মণকে মণ নুন তুলতাছে তোমরা মিয়া এত কম ক্যে? কামে ফাঁকি মারো। হুনতাছি, চুরি কইরা ঘরে নুন নিয়া যাও। আমজাদ সাব’রে কইলে কিন্তু মিয়া খবর খারাপ আছে, কইয়া দিলাম। অই, মফিচ্ছে নুন মাপ।”
বদল মিয়া অগ্নিশর্মা হয়ে তেড়ে এসে বললো, “বদ্দা, আমার মুখ খারাপ কইরবেন না। কোন মাগিরপোত কইছে আমি নুন চুরি কইচ্ছি? “হেতের নামড়া কন আপনে,” সোনা মিয়াও কম যায় না।
ইয়াসিন ইতস্তত করে বললো, ‘আইচ্ছা, বাদ দে। সইন্ধ্যায় আমজাদ সাবের অফিসে যাইস।’
লবণ নিয়ে আমজাদের লোকজন চলে যাচ্ছে আর বদল মিয়া সেদিকে অপলকে চেয়ে ভাবে তাদের ঘামের মূল্যটাকে কিভাবে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে।
বদল মিয়া চৈতন্য ফিরে পায় সোনা মিয়ার ডাকে। আমজাদের লোক চলে গেলে সোনা মিয়া বলে, “বদল, দেখছস কামড়া? আমরা মাইপা রাখছিলাম ১০০ মণ। এখন হইল কয় মণ? ৭৮ মণ!”
‘সে আর নতুন কি! আমগোরে যে চোর বানায় দিল, এইটা কি হইলো?’
‘নরমেরে হক্কলে মারে, এইটা আবার নতুন কী!” সোনা মিয়ার আফসোসের সুর।
সন্ধ্যাকালে আমজাদের অফিসে যায় বদল আর সোনা মিয়া। আমজাদ হোসেন তাদের উপর লবণ চুরির অভিযোগ এনে গালিগালাজ করে। বদল মিয়া লবণের টাকা চাইলে আমজাদ বলে যে, চার/পাঁচ দিনের ভেতর টাকা পাবে না। বদল মিয়া অনেক অনুনয় বিনয় করে, পোয়াতি বউয়ের কথা বলে, ক’দিনের মধ্যেই বাচ্চা হওয়ার কথা বলে। কিন্তু তাতে আমজাদ সাহেবের পাষাণ হৃদয় গলেনি।
পরদিন রাতেই বদল মিয়ার বউ একটা মরা সন্তানের জন্ম দেয়। টাকার জন্য তার স্ত্রীকে গাইনী ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারেনি বদল মিয়া।
ভাগ্য ভালো যে বউয়ের কিছু হয়নি। বদল মিয়ার ভেতর অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে। নিজেকে খুনি মনে হতে লাগল।
সে ভাবতে ভাবতে একদিন অন্ধকার রাতে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। হঠাৎ তার মনে হলো, তার সন্তানের খুনি তো সে নয়। খুনি তো আমজাদ। হ্যাঁ, আমজাদই খুনি। দরিদ্র কৃৃৃষকের রক্তচোষা আমজাদ।
এবার বদল মিয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। তীব্র অন্ধকার চিরে সে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “রক্তচোষা খুনিদের বিরোদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবো। তীব্র আন্দোলন।”
তার চিৎকারে নারকেল গাছে বসা চোর বাদুড়টা তীব্র বেগে ওড়ে গেল।
লেখক;
হামিদুল ইসলাম আরফাত
শিক্ষার্থী
সাদা সোনা খ্যাত লবণ নিয়ে লেখা ২য় প্রতিবেদনটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
[…] ও লবণের মূল্য হ্রাস। পান ও লবণ দুটোই অর্থ […]
[…] লবণের মূল্য কেমন থাকে। চাষিরা কি আদৌও লবণের ন্যায্যমূল্য […]
[…] থেকে পুরোদমে শুরু হলো মহেশখালীর সাদা সোনা খ্যাত লবণ উৎপাদনের মৌসুম। কিন্তু লবণের […]