প্রথমে কয়েকটা খারাপ খবর দিই, নইলে এই মাস্কহীন এবং আপাত করোনাহীন বাংলাদেশে ভ্যাক্সিনের প্রয়োজনীয়তা বুঝবেন না-
১. কুমিল্লা মেডিক্যালের কোভিড ইউনিটে ১-১৭ জানুয়ারি ৫২ জন করোনার সিম্পটম নিয়ে মারা গেছেন।
২. ইউকে, পর্তুগাল এবং আফ্রিকায় নতুন এক ভাইরাল স্ট্রেইন আসছে।ইউকের ভাইরাসটি পূর্বের তুলনায় ৭০% বেশি সংক্রামক,৩০% বেশি মারাত্মক (Deadly), এটি বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না তার গ্যারান্টি কি!
৩. কোভিড একবার হয়ে গেলে সুস্থ হলেও রক্ষা নাই,তারপরে জটিলতা আরো মারাত্মক। শরীরের রক্ত জমাট বেধে পরবর্তীতে স্ট্রোক এবং হার্ট এটাকের ঝুকি বেড়ে যায় বহুগুন।
ভ্যাক্সিন কেন নিবেনঃ
১. ভ্যাক্সিন নেয়ার পরে আপনার করোনা হওয়ার চান্স কমে আসবে,হলেও তার ফলে যে জটিলতা এবং মৃত্যুর ঝুকি সেটা কমে আসবে।সোজা ভাষায় ভ্যাক্সিন নেয়ার পরেও আপনি করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন,কিন্তু ‘অসুস্থ’ হবেন না!
২. করোনার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল আপনি কোন লক্ষন প্রকাশ না করেই পরিবারের আরেকজনকে সংক্রমিত করতে পারেন এবং সেই ব্যক্তি করোনায় মৃত্যুবরন করতে পারেন।আপনার হয়ত বয়স কম,রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল বলে আপনি করোনায় বেঁচে গেলেন কিন্তু বয়স্ক বাবা মা’র মৃত্যুর কারণ হবেন না তার নিশ্চয়তা কই?ভ্যাক্সিন সেই নিশ্চয়তা দিতে পারে- ভ্যাক্সিনকে অন্যকে সংক্রমিত করার হার কমাতে পারে।
৩. এখন বিদেশ যেতে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট লাগে,সামনে হয়তো ভ্যাক্সিন দেয়া হইছে সেই সার্টিফিকেট লাগবে।ইউরোপে না আসেন,হজে যেতে চাইলেও সেই সার্টিফিকেট লাগতে পারে।ভারতে চিকিৎসার জন্য যেতে চাইলেও ভ্যাক্সিন দেয়া হইছে তার প্রুফ লাগলে অবাক হবেন না।
৪. এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- পুরো পৃথিবীর জন্য ভ্যাক্সিন দরকার।এই একটা কারনেই তুলনামূলক কম লাভে দুনিয়াব্যাপী ভ্যাক্সিন পাঠাচ্ছে ইউরোপ আমেরিকা। এই ভাইরাস শুধুমাত্র লকডাউন, মাস্ক, সেনিটাইজার দিয়ে পৃথিবী থেকে তাড়ানো সম্ভব না তা অলরেডি প্রমাণিত। মাস্কহীন ভাইরাসমুক্ত পৃথিবীর জন্য ভাইরাসটির সংক্রমন কমাতে হবে,সেই নিশ্চয়তা দিতে পারে ভ্যাক্সিনের সাথে স্বাস্থ্যবিধির যুগপৎ সম্মিলন।বলা হচ্ছে পৃথিবীর ৭৫-৮৫% লোককে হয় প্রাকৃতিক ভাবে ভাইরাস কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে অথবা এই ভাইরাসের ভ্যাক্সিন নিয়ে রোগ প্রতিরোধী (HERD IMMUNITY) হয়ে উঠতে হবে।পৃথিবী থেকে দুটি রোগ চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছে- গুটিবসন্ত এবং পোলিও,তা একমাত্র সম্ভব হয়েছে ভ্যাক্সিনের কারণে!!
ভ্যাক্সিন বিতর্কঃ
১. নরওয়েতে ২৩ জন টিকা পাওয়ার পরে মৃত্যুবরণ করেছেন,জি ঘটনা সত্য।কিন্তু তারা টিকার সাইড ইফেক্টে মারা গেছেন তা প্রমাণিত নয়।তারা সবাই বয়স্ক লোক,হয়ত বয়সের কারণে বা অন্য কোন কারণে মারা গেছেন তাও হতে পারে।তাই খোদ নরওয়েতেই এখনো টিকা দেয়া হচ্ছে।আর একটা কথা-যে টিকা তাদের দেয়া হইছে (ফাইজার), সেটা বাংলাদেশে দেয়া হচ্ছে না।ভবিষ্যতে দেয়ার চান্স ও কম,কারন এটার দাম বেশি,সংরক্ষন করতে হয় মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায়, সে সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই।
২. ভারতীয় ভ্যাক্সিন ট্রায়াল- ভারতে দুইটি ভ্যাক্সিন উৎপন্ন হচ্ছে- একটা ভারতের নিজস্ব,যেটার বেশ কিছু সাইড ইফেক্ট ভারতে পাওয়া গেছে।আশার কথা হল সেটা বাংলাদেশে এখনো পাঠানো হয়নি।যেটি বাংলাদেশে পাঠানো হইছে সেটা ইউকের অক্সফোর্ডের প্রযুক্তিতে ভারতের ‘কারখানা’য় উৎপাদিত টিকা।সেই সেইম টিকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেয়া হচ্ছে।আমাদের দেশে প্রতিবছর বাচ্চাদের যে টিকা দেয়া হয়,সেটাও কিন্তু ভারতে উৎপন্ন হয়।
৩. ভারত কেন নিজ দেশে সবাইকে না দিয়ে বাংলাদেশকে দিবে- এটার কারণ হার্ড ইমিউনিটি।আপনি নিজের দেশে টিকা দিয়ে দরজা বন্ধ রাখতে পারবেন না।পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে টিকা ছাড়া লোক আসলে আবার আপনার দেশে ছড়ায় যাবে।সো পাশের দেশের দিকেও নিজের স্বার্থেই খেয়াল রাখতে হবে।চায়না,রাশিয়া বাংলাদেশকে ফ্রি ভ্যাক্সিন দিতে চায়,রাশিয়ার ভ্যাক্সিন আজ পাকিস্তান অনুমোদন দিয়েছে।বুঝতেই পারছেন ভারত কেন চায়না,রাশিয়ার আগে বাংলাদেশে ভ্যাক্সিন দিতে এত আগ্রহী।তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল- ভ্যাক্সিন ডিস্ট্রিবিউশন এর পলিসি ভারতের একার না,এটা ভারত অক্সফোর্ডের একসাথে মিলে করা পলিসি।
৪. কেন অন্য ভ্যাক্সিন না নিয়ে ভারতীয় ভ্যাক্সিন নিব-
প্রথম কথা এটা ভারতীয় ভ্যাক্সিন না, এটা ইউকে অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিন যেটা ইউকে নিজ দেশে সহ অনেক দেশেই দিচ্ছে।এটার ট্রায়াল শেষ করে সব ডাটা সবার সামনে উন্মুক্ত করা হইছে।রাশিয়া আর চায়নার ভ্যাক্সিনের ফুল ট্রায়াল শেষ হয়নি,সব ডাটাও উন্মুক্ত নয়।আমেরিকার ফাইজার আর মডার্নার ভ্যাক্সিন এর দাম এটার কয়েকগুন,সংরক্ষন করতে হয় অনেক কম তাপমাত্রায় যেটা বাংলাদেশে সম্ভব নয়।
৫. ইফেক্ট এবং সাইড ইফেক্ট- ডাটা অনুসারে এই টিকা মাত্র ৬২% কার্যকর,তাও কেন দিব? কারন টিকা না দিলে সেই ৬২% কার্যকারিতাও আপনি পাবেন না,আর টিকা আপনি ফ্রি পাবেন,টাকা ছাড়া ৬২% কার্যকারিতা কেন নিবেন না?
যেকোন টিকার ই সাইড ইফেক্ট আছে,ছোট বাচ্চাদের টিকা দিলেও প্রথম দিন জ্বর হয়।ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই জানি অক্সফোর্ডের টা দিলে আপনার জ্বর,মাথাব্যথা,শরীরব্যথা হবে,সেটা আপনাতেই দুদিনেই সেরে যায়। এই টিকা নিয়ে বড় কোন জটিলতা হইছে বা মারা গেছে এমন কোন প্রুফ এখনো নাই।
আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি ৬৬ জন কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তির একজন মারা যাচ্ছেন,সুস্থ হবার পরে পরবর্তীতে কোভিড জটিলতায় স্ট্রোক/ হার্ট এটাকে মারা যাচ্ছেন সেটার হিসাব কিন্তু এখানে নাই।তাই মাস্কহীন ভাবে ভবিষ্যতে আপনার বাবা মা সহ বাচঁতে হলে ভ্যাক্সিন এবং স্বাস্থ্যবিধি এই দুই যুগলবন্দীর আপাত কোন বিকল্প নাই!
লেখকঃ
ডাক্তার মুহাম্মদ হোজাইফ উল্লাহ (এমবিবিএস),
জুনিয়র ক্লিনিক্যালঃ ফেলো
এক্সিডেন্ট এন্ড ইমার্জেন্সি;
ডাডলি, ইউ.কে।